image

শহিদ মোঃ আইনুল হক

  • ১৫ জানুয়ারি ১৯৮৮
  • |
  • ২০তম

শহিদ মোঃ আইনুল হক

শহিদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২০তম শহিদ হলেন মোঃ আইনুল হক। নিশ্চিত ধারণা করা হয় যে, ১৯৮৮ সালের আজকের এই দিনে (১৫ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ছাত্রসমাজের কুখ্যাত হামিদচক্র মোঃ আইনুল হককে খুন করে লাশ গুম করেছে। আজও তাঁর লাশের সন্ধান মেলেনি।

 

শাহাদাতের ঘটনা :

ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং নিজের স্বৈরাচারী শাসনকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এক ভয়ঙ্কর অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে গড়ে তুলেছিলেন পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী, জাতীয় ছাত্রসমাজ। ওই বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসের কারণে শিক্ষাঙ্গনগুলোর পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে থাকে সেই শাসনামলে। দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও ওই সন্ত্রাসের বাইরে ছিল না।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলে সরকার ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের শেষার্ধে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ ৬০ দিন বন্ধ থাকার পর ১৯৮৮ সালে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেয়। সে অনুযায়ী সে বছরের ৭ জানুয়ারি আবাসিক হলগুলো ও ১০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসী ছাত্রসমাজের কুখ্যাত হামিদ বাহিনী ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সময় ২টি বাস, ১টি মাইক্রোবাস ও ১টি জিপে করে গুলি করতে ক্যাম্পাসে ঢুকে দখলদারি কায়েম করে। দখলকৃত ক্যাম্পাসে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়।

সে সময় মোঃ আইনুল হক ও তাঁর বন্ধু হাবিবুর রহমান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে ছিলেন। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম ঘুরতে ঢাকা থেকে রওয়ানা করে ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন তাঁরা। একদিন চট্টগ্রাম অবস্থান করে পরদিন অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা হন দুজন। এর আগে কখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে মোঃ আইনুল হকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকতেন, নাম হাবীব রেজা। বন্ধুর সাথে কথা ছিল, দেখা হবে, তাই যাওয়া। কিন্তু তাঁরা ক্যাম্পাসের অবস্থা ঠিকঠিক জানতেন না। ক্যাম্পাস যখন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দখলে, যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছেন না, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রোভিসি, শিক্ষক সমিতি এবং দশটি সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন সংবাদমাধ্যমে বারবার জানাচ্ছিলেন যে, পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক, ছাত্ররা ক্রমশ হলে ফিরে আসছে ইত্যাদি। এসব বানানো গল্পের কারণেই অনেকেই দূরের বাড়ি থেকে এসে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন।

১৫ তারিখ সকাল এগারোটার দিকে রিকশায় করে ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিলেন দুই বন্ধু। টহলরত সন্ত্রাসীদের একদল এসে তাঁদের জোর করে থামায়, সাথে থাকা অর্থ-কড়ি জিনিসপত্র কেড়ে নেয় এবং দুজনকে আটকে আলাওল হলে নিয়ে যায়। তারপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন, রাইফেলের বাঁট আর রড দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর। ৬/৭ জন মিলে তীব্রভাবে মারতে শুরু করে মোঃ আইনুল হককে, এক পর্যায়ে রক্তাক্ত মোঃ আইনুল হক জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। ঘাতকরা তাঁকে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যায়। সেই থেকে হাবিব আর তাঁর বন্ধুর হদিস পাননি সামনা-সামনি।

ওদিকে হাবিবকে আলাওল হলের ২২১ নম্বর কক্ষে একটানা ০৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ তারিখ পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে পটিয়ায় নিয়ে গিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ তারিখ পর্যন্ত হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি দিয়ে আটকে রাখে সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘ ৩৩ দিন পর দুর্বৃত্তরা হাবিবকে চোখ বন্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম শহরে এনে ছেড়ে দেয়। হাবিব ঢাকায় ফিরে আসেন, কিন্তু মোঃ আইনুল হকের সন্ধান মেলেনি আর। মোঃ আইনুল হকের জন্য তাঁর পিতা-মাতা, ভাই-বোন হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক তালাশ করেন। দুর্বৃত্তরা যে মোঃ আইনুল হককে হত্যা করেছে তা নিশ্চিত। হাবিব ছাড়া পেয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দেন। অবশ্য সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে।




পরিচয় :

শহিদ মোঃ আইনুল হক ছিলেন গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর থানার মহারাজপুর গ্রামের মোঃ হারেস শেখের ছেলে। তিনি তাঁর তিন ভাই ও এক বোনের মাঝে সবার বড়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের মাস্টার্স শেষবর্ষের ছাত্র মোঃ আইনুল হক ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখার সাথী মানের জনশক্তি ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে খুবই দক্ষ, সাহসী ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন শহিদ মোঃ আইনুল হক অকালে পুত্র হারানোর শোকে একদিন শহিদের মা ইন্তেকাল করেন। বাবা মোঃ হারেস শেখ এখনও পাগলের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পাহাড়ে পাহাড়ে তার সন্তানকে তালাশ করে ফেরেন। কিন্তু কেউই আর ফিরিয়ে দিতে পারে না জান্নাতবাসী শহিদ আইনুল হককে। আল্লাহ প্রিয় ভাইটিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।

 

একনজরে শহিদ আইনুল হক :

নাম : মোঃ আইনুল হক
বাবার নাম : মোঃ হারেস শেখ
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম - মহারাজপুর, থানা - মোকসেদপুর, জেলা - গোপালগঞ্জ
পরিবারের মোট সদস্য : ৬ জন (বাবা, মা, তিন ভাই ও এক বোন)
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : সবার বড়
সর্বশেষ পড়াশোনা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (এমএসসি, ভূগোল, শেষবর্ষ)
সাংগঠনিক মান : সাথী (ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা)
শাহাদাতের তারিখ : ১৫ জানুয়ারি, ১৯৮৮

শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আঘাতের ধরন : রাইফেলের বাঁট, রড, লাঠি